ওমরাহ ভিসায় বড় সংকট: সৌদি সিদ্ধান্তে বিপাকে হাজারো বাংলাদেশি
হঠাৎ করেই আসন্ন হজের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সৌদি আরব ওমরাহ ভিসার কোটা প্রায় ৯০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, যা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাজারো বাংলাদেশি ওমরাহযাত্রী। কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই সৌদি কর্তৃপক্ষ এই পদক্ষেপ নেওয়ায়, দেশটির এজেন্সিগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ওমরাহ ভিসা ইস্যু করতে পারছে না।
ওমরাহযাত্রীদের দুর্ভোগ ও টিকিটের অর্থ ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ
এই সিদ্ধান্তের ফলে হাজার হাজার যাত্রীর ভিসা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেকেই রমজানে ওমরাহ পালনের আশায় এজেন্সির মাধ্যমে অগ্রিম টিকিট বুকিং করেছিলেন। কিন্তু ভিসা না হওয়ায় তারা এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। একই সঙ্গে এয়ারলাইনসগুলোও টিকিটের টাকা ফেরত না দেওয়ায় ওমরাহযাত্রী ও এজেন্সি মালিকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হাব (হজ এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ) সৌদি সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে দ্রুত ভিসা ইস্যু পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছে। এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ও সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “এটি পুরোপুরি সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত, এখানে বাংলাদেশের কোনো হাত নেই। টিকিটের টাকা ফেরতের বিষয়ে সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে আলোচনা করা হচ্ছে, এবং বিষয়টি সৌদি সরকারকে জানানো হবে।”
রমজানে ওমরাহর চাহিদা ও আকস্মিক ভিসা সংকট
প্রতি বছর রমজান মাসে ওমরাহ পালনে আগ্রহী মুসল্লিদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ বছরও বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষ রমজানে ওমরাহ করার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী অগ্রিম টিকিট বুকিং দিয়েছিলেন। সাধারণত রমজানের শেষ সপ্তাহে (২৫-৩০ তারিখ) সৌদি সরকার ওমরাহ ভিসা ইস্যু বন্ধ রাখে। তবে এবার কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ৪ মার্চ থেকে ওমরাহ ভিসার সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সৌদি ‘নুসুক’ সিস্টেমের মাধ্যমে ওমরাহযাত্রীদের মোফা (ভিসার অনুমতি) ইস্যু করা সম্ভব হচ্ছে না, এবং সার্ভারে প্রবেশ করলেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দকৃত দৈনিক ভিসার সংখ্যা শেষ। এতে যাত্রীরা চরম হতাশায় পড়েছেন।
এজেন্সিগুলোর ক্ষতি ও যাত্রীদের বিক্ষোভ
ওমরাহ ভিসা ইস্যু বন্ধ হওয়ায় অনেক এজেন্সি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। অনেক এজেন্সির মালিক জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে বিমানভাড়া, হোটেল বুকিং ও অন্যান্য খরচ বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। কিন্তু যাত্রীরা ভিসা না পাওয়ায় এজেন্সিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন এবং টাকা ফেরত চাচ্ছেন।
হাবের মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, “আমরা সবচেয়ে বেশি বিপদে আছি। যাত্রীরা আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে, অথচ এটি সম্পূর্ণ সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আমাদের নিজেদের পকেট থেকে টাকা ফেরত দিলে ব্যবসায় ধস নামবে।”
আলফু-জোনায়েদ হজ ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক জানান, তার এজেন্সির ৩০ জন যাত্রী ১৬ মার্চ সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য তিনি ইতোমধ্যে বিমান ভাড়া ও হোটেল বাবদ ৪২ লাখ টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু এখন ভিসা না হওয়ায় যাত্রীরা তার অফিসে এসে বিক্ষোভ করছেন এবং টাকা ফেরত দাবি করছেন।
এয়ারলাইনসের নীরবতা ও সরকারি প্রতিক্রিয়া
টিকিটের অর্থ ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে এয়ারলাইনসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) আবু আহমেদ শুভর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আল মাসুদ খান বলেন, “যেসব ওমরাহযাত্রী বিমানে অগ্রিম বুকিং দিয়েছেন, তারা নিয়ম অনুযায়ী রিফান্ড বা তারিখ পরিবর্তন করতে পারবেন।” তবে অন্যান্য এয়ারলাইনসের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক জানিয়েছেন, “সৌদি সরকার কেন হঠাৎ ভিসা ইস্যু বন্ধ রেখেছে, তা জানতে তাদের দূতাবাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।”
এদিকে, এবারের হজে ১৫ বছরের কম বয়সীরা অংশ নিতে পারবেন না, সৌদি সরকার নতুন করে এই নিয়ম চালু করেছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৫ বছরের বেশি বয়সীরা তাদের স্থলে যেতে পারবেন।
ওমরাহ সংকটের সম্ভাব্য কারণ
সূত্র জানিয়েছে, গত ১ জুলাই ২০২৪ থেকে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করেছেন। রমজানে প্রচণ্ড ভিড় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সৌদি সরকার নতুন নিয়ম কার্যকর করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, মক্কার স্থান সংকুলানের বিষয়টি মাথায় রেখে ভিসা সংখ্যা কমানো হয়েছে।
ওমরাহ যাত্রীদের এই সংকট কতদিন চলবে বা কবে নাগাদ ভিসা ইস্যু পুনরায় শুরু হবে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি। তবে হাব ও ধর্ম মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বিষয়টি নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।