১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদ, যাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ, তাদের আর ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। পরিবর্তে তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের সংশোধিত খসড়ায় এই পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ।
রোববার (২৩ মার্চ) এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এই বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা না বলে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ বলা কি তাদের সম্মান বৃদ্ধি করবে, নাকি অসম্মান করবে? স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা যৌক্তিক? তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার নেপথ্যে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে?
জামুকার প্রস্তাব ও সোহেল তাজের প্রতিক্রিয়া
জানা গেছে, জামুকার ৯৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ১০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সংশোধিত খসড়া রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেন। এতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী রাজনীতিবিদদের মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে উল্লেখ করার প্রস্তাব রাখা হয়।
এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সোহেল তাজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না দেওয়া তাদের ভূমিকা খাটো করার শামিল। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রত্যাহার করেছিল, যা পরে টেকেনি। ইতিহাসে যার যা অবস্থান, তা স্থায়ী এবং এটি পরিবর্তনের চেষ্টা করলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করবে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও বিতর্কের জন্ম
সোহেল তাজ উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে এবং তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা যদি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পান, তাহলে সেটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি বলে মনে হবে।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মানে শুধুমাত্র অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কেউ সরাসরি রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন, কেউ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণে অস্ত্রধারী ও সংগঠকদের মধ্যে পার্থক্য করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
সোহেল তাজ অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে, যার মূল কাজ হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি সচল রেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু তারা কেন এমন একটি ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে?
তিনি সতর্ক করে বলেন, যারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে প্রচেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসছে, এই সিদ্ধান্ত সেটিকেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও ইতিহাস অস্বীকার করে কোনো নতুন সংজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে জনগণ তা মেনে নেবে না।