জার্মানি ও ইতালির $২৪৫ বিলিয়ন মূল্যের স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনার চাপ বাড়ছে
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেডের উপর সমালোচনা ও বৈশ্বিক অস্থিরতা ইউরোপে স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার বিতর্ক জোরদার করছে
জার্মানি ও ইতালি বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম জাতীয় স্বর্ণ রিজার্ভ ধারণকারী দেশ। তবে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের একটি বড় অংশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে সংরক্ষিত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জোরালোভাবে দাবি উঠছে এই স্বর্ণ ইউরোপে ফিরিয়ে আনার।
বিশ্ব স্বর্ণ পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানির স্বর্ণ রিজার্ভের পরিমাণ ৩,৩৫২ টন এবং ইতালির ২,৪৫২ টন। এর মধ্যে উভয় দেশই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তার বেশি স্বর্ণ নিউ ইয়র্কে সংরক্ষণ করে রেখেছে। FT-এর হিসাব অনুযায়ী, এই স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ডলার।
রাজনৈতিক উদ্বেগ ও জনমত
জার্মানির বামপন্থী রাজনীতিবিদ ফাবিও ডে মাসি এক সাক্ষাৎকারে জানান, “বর্তমান অস্থির সময়ে ইউরোপ বা নিজ দেশে স্বর্ণ সংরক্ষণের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে।” অপরদিকে, ডানপন্থী রাজনীতিবিদ পিটার গাউভেইলার বলেন, “আমাদের এখন প্রশ্ন তুলতে হবে, বিগত এক দশকে বিদেশে স্বর্ণ সংরক্ষণ আরও নিরাপদ হয়েছে কিনা। উত্তর তো স্পষ্ট।”
একই ধরণের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ট্যাক্সপেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মাইকেল জ্যাগারও, যিনি জার্মানি ও ইতালির অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি লিখে স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইতালির অবস্থান ও রাজনীতির পালাবদল
২০১৯ সালে ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মেলোনি এই ইস্যুতে নীরব। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ এড়াতে চাইছেন।
জার্মানির পূর্ব অভিজ্ঞতা
২০১০ সালে একটি জন-আন্দোলনের পর ২০১৩ সালে জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশের অর্ধেক স্বর্ণ রিজার্ভ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সেই অনুযায়ী নিউ ইয়র্ক ও প্যারিস থেকে ৬৭৪ টন স্বর্ণ ফ্র্যাঙ্কফুর্টে স্থানান্তর করা হয়, যার খরচ পড়ে প্রায় ৭ মিলিয়ন ইউরো। বর্তমানে জার্মানির ৩৭% স্বর্ণ এখনও নিউ ইয়র্কে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
আর্থিক বিশেষজ্ঞ পিটার বোহরিঞ্জার বলেন, “স্বর্ণ হলো শেষ রক্ষার সম্পদ। তাই এটি এমন স্থানে সংরক্ষণ করা উচিত যেখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বা ঝুঁকি না থাকে।” তবে জার্মান বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ফ্লসব্যাখ ফন স্টর্ক-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা বার্ট ফ্লসব্যাখ বলেন, “এই মুহূর্তে স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি নির্দেশ করবে।”
জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বুন্ডেসব্যাংক) জানিয়েছে, তারা স্বর্ণের নিরাপত্তা ও তরলতা বিবেচনায় নিয়মিতভাবে সংরক্ষণস্থল পর্যালোচনা করে থাকে। নিউ ইয়র্ক ফেড তাদের জন্য এখনও একটি “গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার” বলেও জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরাপত্তা সংশয়
জার্মান সংসদের ডানপন্থী দলের সদস্য পিটার বোয়েরিঞ্জার বলেন, “স্বর্ণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। এটিকে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি ছাড়াই দেশের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।”
একইভাবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির ক্ষমতায় আসার আগে দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ও স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যদিও ক্ষমতায় আসার পর মেলোনি এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি, বরং ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছেন বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
তবে জার্মান রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দাবি পেয়েছে সব রাজনৈতিক পক্ষের সমর্থন। এমনকি ইউরোপীয় করদাতা সমিতিও উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই স্বর্ণ ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অবস্থান
জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বান্ডেসব্যাংক জানিয়েছে, তারা তাদের স্বর্ণের সঞ্চয়স্থল নিয়মিত পর্যালোচনা করে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ এখনো “বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য” অংশীদার বলে তারা মনে করে।
অন্যদিকে ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয় এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে
একটি সাম্প্রতিক জরিপে ৭০টিরও বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছে, তারা এখন নিজ নিজ দেশে স্বর্ণ রাখার চিন্তা করছে, যাতে সঙ্কটের সময় তাদের সম্পদে অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যায়।