যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসনকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মতামত জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশটির সাধারণ মানুষ এখন অভিবাসন ও আশ্রয়প্রার্থীর বিষয়কে সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সেই দাবিকে সমর্থন করে না।
২০১১ সাল থেকে জরিপ সংস্থা ইউগভ (YouGov) নিয়মিতভাবে যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইছে। কয়েক সপ্তাহ আগে “অভিবাসন ও আশ্রয়” বিষয়টি তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে|
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটিশ জনসাধারণের একটি বড় অংশ মনে করেন অভিবাসন ও আশ্রয়প্রার্থীরাই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটের সময়ও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তবে গবেষকরা বলছেন, এই উদ্বেগ বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাস্তব সমস্যা বনাম অভিবাসন আতঙ্ক
অর্থনীতিতে ধীর প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ কর এবং স্বাস্থ্যসেবার সংকট—এসব বাস্তব সমস্যার মাঝেও কেন হঠাৎ অভিবাসন বড় ইস্যু হয়ে উঠছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গবেষকরা বলছেন, দৈনন্দিন জীবনে ব্রিটিশ নাগরিকদের যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়—চাকরির অভাব, অপরাধ, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা আবাসন সংকট—এসবের সঙ্গে সরাসরি অভিবাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিপরীতে, যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য খাতে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী কর্মরত। এ ছাড়া দেশের কর কাঠামোতেও অভিবাসীরা বড় কোনো বোঝা তৈরি করেননি।
ভুল ধারণা ও বাস্তবতা
অর্থনীতিবিদ আলবার্তো আলেসিনা, আর্মান্দো মিয়ানো এবং স্টেফানি স্ট্যানচেভা পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যুক্তরাজ্যের মানুষ অভিবাসীদের সংখ্যা, ধর্ম ও উৎস নিয়ে ব্যাপক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন।
আশ্রয় ব্যবস্থা বনাম আসল খরচ
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের আশ্রয়প্রার্থী ব্যবস্থাপনার ব্যয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে ছিল ৫০ কোটি পাউন্ডের নিচে, সেখানে ২০২৩-২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি পাউন্ডে।
যদিও এ খরচ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও এটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (NHS)-এর তুলনায় নগণ্য—কারণ এনএইচএস প্রায় প্রতি ১০ দিনেই এত টাকা ব্যয় করে থাকে।
অভিবাসীদের অবদান
তথ্য বলছে, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিদেশি-জন্ম নাগরিকদের বড় অংশ কর্মক্ষম বয়সে আছেন। তারা সাধারণত ব্রিটিশদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত, সুস্থ এবং আর্থিকভাবে কম চাপ সৃষ্টি করেন।
ভুল ধারণা ও বাস্তব চিত্র
অর্থনীতিবিদ আলবার্তো আলেসিনা, আর্মান্দো মিয়ানো ও স্টেফানি স্তান্তচেভা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের জনগণ অভিবাসন নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। তারা মনে করেন, দেশটিতে মুসলিম অভিবাসীর সংখ্যা আসল সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা তারা বাস্তবের তুলনায় দশ গুণ বেশি বলে মনে করেন। একইভাবে তারা অভিবাসীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নিয়েও ভুল ধারণা রাখেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তরুণ, কর্মক্ষম ও শিক্ষিত। প্রায় ৯০ শতাংশ অভিবাসী ভালো ইংরেজি জানেন এবং ৭৫ শতাংশ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। অর্থাৎ তারা কেবল খরচ বাড়াচ্ছেন না, বরং শ্রমবাজার ও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
আর্থিক বোঝা কতটা?
সত্য যে, আশ্রয় প্রক্রিয়া পরিচালনার সরকারি ব্যয় বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে খরচ ছিল ৫০ কোটি পাউন্ডেরও কম, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ বিলিয়ন পাউন্ডে। তবে তুলনামূলকভাবে এটি খুব বড় অঙ্ক নয়—কারণ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার (NHS) বাজেট এত অর্থ ব্যয় করে মাত্র দশ দিনে।
যুক্তরাজ্যের প্রকৃত সমস্যাগুলো—অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবনযাত্রার ব্যয়—অভিবাসন দ্বারা সৃষ্ট নয়। বরং জনমনে আতঙ্ক ও ভুল তথ্য প্রচারের কারণে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বড় হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার ফারাক বোঝা জরুরি।