যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের জন্য ইংরেজি ভাষার যোগ্যতা আরও কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর (Home Office)। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ভিসা আবেদনকারীদের কথা বলা, শোনা, পড়া এবং লেখায় এ-লেভেল (A-level) স্ট্যান্ডার্ডের সমতুল্য দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই কঠোরতা মূলত অভিবাসন ব্যবস্থার বৃহত্তর সংস্কারের অংশ হিসেবে আনা হচ্ছে, যার লক্ষ্য সামগ্রিক অভিবাসন সংখ্যা হ্রাস করা এবং কর্মীদের আরও ভালোভাবে সমাজে অঙ্গীভূত করা।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর ২০২৫) হাউস অফ কমন্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্র দফতর জানায়, নতুন ভাষা যোগ্যতা ২০২৬ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। প্রাথমিকভাবে এটি Skilled Worker (দক্ষ কর্মী), High Potential Individual (উচ্চ সম্ভাবনাময় ব্যক্তি) এবং Scale-up (স্কেল-আপ) ভিসার জন্য প্রযোজ্য হবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনের শেষ হওয়া বছরে এই তিনটি রুটের মাধ্যমে ৪০,০০০-এরও বেশি কর্মীকে ইউকে ভিসা দেওয়া হয়েছিল।
দক্ষ অভিবাসনে সহায়তা
উচ্চ সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের (HPI) ভিসা সম্প্রসারণ:
২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর থেকে এই ভিসার আওতায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় এতে অন্তর্ভুক্ত হবে। পাশাপাশি, আবেদন সীমা বছরে ৮,০০০ নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্লোবাল ট্যালেন্ট ভিসা উন্নয়ন:
২০২৫ সালের ১১ নভেম্বর থেকে এই ভিসার “প্রেস্টিজিয়াস প্রাইজেস” তালিকা ও স্থপতিদের জন্য প্রমাণপত্রের শর্ত আরও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।
ছাত্রদের জন্য নতুন সুযোগ:
২০২৫ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স সম্পন্ন করার পর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করে Innovator Founder ভিসায় পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন।
অভিবাসন ব্যবস্থায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ
গ্র্যাজুয়েট ভিসা সংস্কার:
২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অধিকাংশ স্নাতকের জন্য এই ভিসার মেয়াদ দুই বছর থেকে কমিয়ে ১৮ মাস করা হবে। তবে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা তিন বছরের মেয়াদ বজায় রাখবেন।
ইংরেজি ভাষার মানদণ্ড বৃদ্ধি:
২০২৬ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে Skilled Worker, HPI এবং Scale Up ভিসার জন্য ইংরেজি দক্ষতা B2 লেভেল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনভিত্তিক ভিসায় নতুন শর্ত:
২০২৫ সালের ১১ নভেম্বর থেকে “General Grounds for Refusal” নিয়ম প্রযোজ্য হবে, যা ভালো চরিত্র ও আচরণের উচ্চ মান নিশ্চিত করবে।
অতিরিক্ত পদক্ষেপ
ইমিগ্রেশন স্কিলস চার্জ বৃদ্ধি:
একটি আলাদা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই চার্জ ৩২% পর্যন্ত বাড়ানো হবে, যাতে বিদেশি কর্মীর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ব্রিটিশ কর্মীদের দক্ষতায় বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়।
স্থায়ী বসবাস ও নাগরিকত্ব নিয়ে পরামর্শ:
২০২৫ সালের শেষের দিকে ‘Earned Settlement and Citizenship’ বিষয়ে জনপরামর্শ (consultation) প্রকাশ করা হবে।
অবৈধ কাজ রোধে উদ্যোগ:
এই মাসের শেষের দিকে হোম অফিস ছয় সপ্তাহব্যাপী জনপরামর্শ শুরু করবে, যেখানে “রাইট টু ওয়ার্ক” যাচাইয়ের আওতা আরও বিস্তৃত করার বিষয়ে মতামত নেওয়া হবে।
ই-ভিসা (eVisa) প্রবর্তনের পরবর্তী ধাপ:
এই বছরের জুলাই মাসে কাজ ও পড়াশোনার প্রধান আবেদনকারীদের জন্য ৯০ দিনের এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স ভিনিয়েট তুলে দেওয়া হয়েছে। আসন্ন ধাপে এটি অন্যান্য ভিসা ক্যাটাগরির মূল আবেদনকারী ও তাঁদের নির্ভরশীলদের (dependants) ওপরও প্রযোজ্য হবে।
মান উন্নীত হলো B1 থেকে B2 স্তরে
আগে অভিবাসীদের জন্য ইংরেজি ভাষার B1 স্তর-এর দক্ষতা প্রমাণ করা বাধ্যতামূলক ছিল, যা ভাষার মৌলিক জ্ঞানকেই বোঝাত। নতুন পরিবর্তন সেই মানকে B2 স্তর-এ উন্নীত করেছে। B2 স্তরে একজন ব্যক্তিকে ইংরেজিতে কথা বলা দেশে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন ও কাজ করার এবং সেই ভাষায় অধ্যয়ন করার ক্ষমতা দেখাতে হবে। কমন ইউরোপীয় ফ্রেমওয়ার্ক অফ রেফারেন্স ফর ল্যাঙ্গুয়েজেস (CEFR) অনুযায়ী, B2 স্তর হলো Upper-Intermediate (উচ্চ-মধ্যবর্তী) স্তর, যা উচ্চশিক্ষার প্রবেশাধিকার এবং বেশিরভাগ চাকরিতে সক্রিয় ভাষা ব্যবহারের জন্য চাওয়া হয়। এটি সাধারণত IELTS-এর ৫.৫ থেকে ৬.৫ ব্যান্ডের সমতুল্য। সরকার ধারণা করছে, এই নতুন কঠোর ভাষা যোগ্যতা এবং প্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীলদের জন্য নতুন শর্তাবলী আরোপের ফলে বার্ষিক অভিবাসন প্রায় ৬,০০০ কমবে।
‘বি-ওয়ান’ থেকে ‘বি-টু’ পর্যায়ে উন্নীত মানদণ্ড
এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে কাজ বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ভিসা পেতে আবেদনকারীদের B1 লেভেল ইংরেজি দক্ষতা দেখাতে হতো, যা ভাষার মৌলিক ব্যবহার বোঝানোর একটি মান। নতুন নিয়মে সেই মান বাড়িয়ে B2 লেভেল নির্ধারণ করা হয়েছে—যেখানে আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ইংরেজিভাষী দেশে স্বাধীনভাবে কাজ, বসবাস ও পড়াশোনা করতে সক্ষম।
এই পরিবর্তন মূলত ইউরোপীয় ভাষা কাঠামো (CEFR – Common European Framework of Reference) অনুযায়ী একটি পূর্ণ স্তর উঁচুতে উন্নীত করা। ফলে এখন থেকে আবেদনকারীদের পড়া, লেখা, শোনা ও বলার ক্ষেত্রে আরও উন্নত দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।
সরকারের অবস্থান: ‘সমন্বয় বাড়াবে’
হোম অফিস মন্ত্রী মাইক ট্যাপ বলেছেন, “যাঁরা যুক্তরাজ্যে জীবন গড়তে চান, তাঁদের আমাদের সমাজে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এই ভাষা-মান উন্নয়ন সেই উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।”
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন নিয়ম শুধু অভিবাসীদের মান উন্নত করবে না, বরং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়াবে।
উচ্চশিক্ষিত অভিবাসীদের জন্য নতুন সুযোগ
একই ঘোষণায় সরকার জানিয়েছে, হাই পটেনশিয়াল ইন্ডিভিজুয়াল (HPI) ভিসার আওতায় সুযোগ বাড়ানো হবে। এখন থেকে বিশ্বের আরও দ্বিগুণ সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা এই রুটে আবেদন করতে পারবেন। একই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ইনোভেটর ফাউন্ডার (Innovator Founder) ভিসায় রূপান্তর প্রক্রিয়াও সহজ করা হবে।
তবে, HPI ভিসার আবেদনসংখ্যা বছরে সর্বোচ্চ ৮,০০০-এ সীমাবদ্ধ থাকবে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এই রুটে আবেদন পড়েছিল ১,৮৫০টি।
স্থায়ী বসবাসে সময় দ্বিগুণ
নতুন নীতির আওতায়, যুক্তরাজ্যে ‘ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন’ (ILR) বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য অপেক্ষার সময় পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করা হবে। সরকার বলছে, এতে অভিবাসন হার আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে নতুন নিয়মে নিয়োগকর্তাদের উদ্বেগ বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য, নির্মাণ ও পরিচর্যা খাতের অনেক নিয়োগকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, উচ্চ ভাষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করলে দক্ষ কর্মী ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরির পরিচালক ড. ম্যাডেলিন সাম্পশন বলেন, “সরকারকে একদিকে ভালো ইংরেজি জানে এমন অভিবাসী আনার লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীও নিশ্চিত করতে হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যম দক্ষতার কাজগুলোতে—যেমন প্রযুক্তিগত ও হাতে-কলমে কাজ—এই পরিবর্তনের প্রভাব বেশি পড়তে পারে।”
অভিবাসন নীতিতে ক্রমবর্ধমান কঠোরতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোট নৌকায় চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশকারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর দেশটিতে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার বিভিন্ন কঠোর নীতি ও উচ্চতর মানদণ্ড চালু করছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
অভিবাসন নীতিতে বৃহত্তর সংস্কার
ইংরেজি ভাষার এই পরিবর্তন ব্রিটেনের অভিবাসন ব্যবস্থার বৃহত্তর পরিবর্তনের একটি অংশ। গত মে মাসে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে দক্ষ কর্মী ভিসা সীমিত করা এবং গ্রাজুয়েট ভিসার মেয়াদ কমানোর পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী মাইক ট্যাপ বলেন, ভাষার যোগ্যতার পরিবর্তন “নিশ্চিত করবে যে যারা যুক্তরাজ্যে নিজেদের জীবন গড়তে চান, তারা যেন যুক্তরাজ্যের জীবনে আরও ভালোভাবে মিশে যেতে পারেন।”
নৌকাযোগে ছোট আকারের অভিবাসন বৃদ্ধির পর যুক্তরাজ্যে অভিবাসন-বিরোধী মনোভাবের উত্থানের প্রেক্ষিতে সরকারের মন্ত্রীরা এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। মন্ত্রীরা আরও ঘোষণা করেছেন যে স্থায়ীভাবে বসবাসের মর্যাদা (Indefinite Leave to Remain) পাওয়ার জন্য অভিবাসীদের অপেক্ষার সময় বর্তমান পাঁচ বছর থেকে দ্বিগুণ করে ১০ বছর করা হবে।
উদ্বেগ বাড়ছে নিয়োগকর্তাদের মধ্যে
ভিসা নিয়মের এই ক্রমবর্ধমান কঠোরতা কিছু নিয়োগকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা আশঙ্কা করছেন যে এর ফলে নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিচর্যা (care work)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে কর্মী ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের মাইগ্রেশন অবজারভেটরির পরিচালক ড. ম্যাডেলিন সাম্পশন বলেন, সরকার একদিকে অভিবাসীরা যাতে ভালো ইংরেজি বলতে পারে তা নিশ্চিত করতে চায়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসা কর্মীদের নিয়োগের সুযোগও রাখতে চায়। তিনি মনে করেন, বেশিরভাগ গ্রাজুয়েট চাকরির জন্য ইতিমধ্যেই উচ্চতর ভাষার দক্ষতা প্রয়োজন, কিন্তু নতুন ভাষার শর্তাবলী “মাঝারি-দক্ষতার চাকরিগুলোতে, যেখানে নিয়োগকর্তারা মাঝে মাঝে উচ্চ ভাষার দক্ষতার প্রয়োজন মনে করেন না, সেখানে আরও বেশি প্রভাব ফেলবে।”
এছাড়াও, মঙ্গলবারের ঘোষণায় উচ্চ-দক্ষ স্নাতক (High-skilled graduates) দের জন্য সুযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনাও জানানো হয়। High Potential Individual (HPI) ভিসা রুটের জন্য যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে এবং ছাত্র উদ্যোক্তাদের জন্য Innovator Founder রুটে যাওয়া সহজ করা হবে। যদিও HPI রুটে আবেদনের সংখ্যা বার্ষিক ৮,০০০-এ সীমিত করা হবে।