আল হারামাইন গ্রুপের পারফিউম ব্যবসার আড়ালে দেশের বৃহত্তম হুন্ডি কার্যক্রমের প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর।
পারফিউম ব্যবসার আড়ালে বড় হুন্ডি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে এনবিআর
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) পারফিউম ব্যবসার আড়ালে পরিচালিত দেশের অন্যতম বৃহৎ হুন্ডি কার্যক্রমের তথ্য উদঘাটন করেছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
তদন্তে জানা গেছে, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান আল হারামাইন পারফিউমস, যার মালিক সিলেটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান নাসির। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এ ব্যবসায়ী বর্তমানে গোল্ডেন ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বসবাস করছেন।
বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হুন্ডি নেটওয়ার্ক
সিআইসির তথ্য অনুযায়ী, মাহতাবুর রহমানের ব্যবসা বর্তমানে ৮৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে আল হারামাইন পারফিউমসের শোরুম রয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তার পুরো ব্যবসা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত।
সম্প্রতি, তার সম্পদের খোঁজ নিতে সিআইসির একটি দল ইউএই সফর করে এবং তার অর্থ পাচারের নানা প্রমাণ সংগ্রহ করে। এছাড়া, অন্যান্য দেশে তার সম্পদের তথ্য জানতে সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সিলেটের বাড়িতে তল্লাশি ও সম্পদের জব্দ
দেশে থাকা মাহতাবুর রহমানের সম্পদও এনবিআরের নজরদারিতে রয়েছে। সিলেটে তার বাড়িতে দুই দফা তল্লাশি চালিয়ে ১০৪টি সম্পত্তির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, গত ২২ জানুয়ারি এনবিআর তার ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনের কৌশল
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আল হারামাইন পারফিউমসের শোরুমগুলো মূলত হুন্ডির টাকা লেনদেনে ব্যবহার করা হয়। ঢাকার বসুন্ধরা সিটির শোরুমে টাকা জমা দিলে দুবাইয়ে সিটি সেন্টারে সমপরিমাণ অর্থ দিরহাম আকারে দেওয়া হয়। এসব শোরুমে সাধারণ ক্রেতাদের আনাগোনা প্রায় নেই, বরং বড় অঙ্কের লেনদেনই বেশি হয়।
তদন্তে আরো উঠে এসেছে, মাহতাবুর রহমানের স্বর্ণ চোরাচালানের বিস্তৃত নেটওয়ার্কও রয়েছে। সিআইসি কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন, ঢাকায় ও দুবাইয়ে আল হারামাইন পারফিউমসের শোরুমের আশপাশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেও কোনো ক্রেতা আসতে দেখা যায়নি।
অন্যান্য সংস্থার তদন্ত ও এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া
মাহতাবুর রহমানের বিরুদ্ধে **বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)**সহ একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। এর অংশ হিসেবে, ১২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়। মাহতাবুর রহমান ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।
ব্যয়বহুল সিলেটের বাড়ি ও অর্থের উৎস
সিলেটের ইসলামপুর এলাকায় ‘কাজী প্যালেস’ নামে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিলাসবহুল বাড়ির মালিক মাহতাবুর রহমান। এখানে একসঙ্গে ৫,০০০ মানুষের জন্য অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। এনবিআরের তদন্তে উঠে এসেছে, বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় এবং ব্যবহৃত উপকরণের উৎসও সন্দেহজনক।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আতিথেয়তা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, মাহতাবুর রহমান শেখ হাসিনার সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-আমলাদের আতিথেয়তা দিতেন। দুবাই গেলে তারা তার অতিথি হতেন এবং থাকার-খাওয়ার সমস্ত আয়োজন করতেন মাহতাবুর। তদন্তকারীদের মতে, তিনি রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিদেশে অর্থ পাচার ও সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
মাহতাবুর রহমানের বক্তব্য
এ ব্যাপারে মাহতাবুর রহমান দাবি করেছেন, তিনি হুন্ডির সঙ্গে যুক্ত নন এবং তার আয়ের মূল উৎস আল হারামাইন পারফিউমসের বৈধ ব্যবসা। তবে এনবিআর ও অন্যান্য সংস্থার তদন্ত বলছে, তার ব্যবসায়িক কার্যক্রমের একটি বড় অংশই অর্থ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তদন্ত চলমান রয়েছে, এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিষয়টি চূড়ান্তভাবে যাচাই-বাছাই করছে।