ব্রিটেনের চ্যান্সেলর রাচেল রিভস তার বসন্ত বাজেট ঘোষণায় সরকারি ব্যয়ের ব্যাপক কাটছাঁটের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে দেশটির সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত সুবিধাগুলোর সংকোচন।
কী ঘোষণা করা হয়েছে?
১. সামাজিক সুবিধা (বেনিফিট) কমানো
রিভসের বাজেট ঘোষণার অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত হলো সামাজিক সুবিধার (benefits) ব্যাপক কাটছাঁট। সরকারি হিসাব অনুসারে, এই পরিবর্তনের ফলে আনুমানিক ২.৫ লাখ মানুষ—যার মধ্যে ৫০ হাজার শিশু রয়েছে—দারিদ্র্যের মুখে পড়বে। সরকারের নিজস্ব বিভাগ, ডিপার্টমেন্ট ফর ওয়ার্ক অ্যান্ড পেনশন (DWP), এই তথ্য প্রকাশ করেছে, যা চ্যান্সেলরের বক্তব্যের কয়েক মিনিট পরেই প্রকাশিত হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে ৩.২ মিলিয়ন পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঘোষিত নতুন নীতির আওতায়, ২০২৫-২৬ সালে ইউনিভার্সাল ক্রেডিট সুবিধা £৯২ থেকে বাড়িয়ে ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে £১০৬ করা হবে। কিন্তু পূর্ববর্তী পরিকল্পনায় এই পরিমাণ £১০৭ হওয়ার কথা ছিল।
এছাড়া, প্রতিবন্ধীদের জন্য দেওয়া পার্সোনাল ইনডিপেনডেন্স পেমেন্টস (PIP)-এও বড় পরিবর্তন এসেছে। নতুন নিয়মে ইনক্যাপাসিটি সুবিধা (অক্ষমতার জন্য প্রাপ্ত অর্থসাহায্য) ২০৩০ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখা হবে, অর্থাৎ এটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বাড়বে না।
২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া কঠিন, কারণ বাজেট নজরদারি সংস্থা অফিস ফর বাজেট রেসপনসিবিলিটি (OBR) জানিয়েছে, এই বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ১% হবে।
তবে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ইতিবাচক খবরও রয়েছে। আগামী বছরগুলোর পূর্বাভাস কিছুটা উন্নত হয়েছে—২০২৬ সালে ১.৯%, ২০২৭ সালে ১.৮%, ২০২৮ সালে ১.৭% এবং ২০২৯ সালে ১.৮% প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রিভস দাবি করেছেন, তার সরকারের অধীনে গড়ে প্রতি বছর একজন নাগরিক £৫০০ বেশি উপার্জন করতে পারবে।
৩. সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট
সরকারি ব্যয় পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে সরকারি ব্যয় £৬.১ বিলিয়ন কমানো হবে।
এতে ন্যায়বিচার মন্ত্রণালয় (Ministry of Justice) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Home Office)-এর মতো সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ন্যায়বিচার মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই কারাগার ও আদালতের সংকটে ভুগছে, আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিবাসন সমস্যা ও পুলিশের অপর্যাপ্ততার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
৪. পরিকল্পনা ও আবাসন খাতে সংস্কার
এই বাজেট ঘোষণায় কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। সরকারের পরিকল্পনা সংস্কারের ফলে পরবর্তী পাঁচ বছরে ১.৩ মিলিয়ন নতুন বাড়ি তৈরি হবে।
OBR বলেছে, এই সংস্কারের ফলে দেশের মোট উৎপাদনে স্থায়ীভাবে ০.২% বৃদ্ধি হবে, যা ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত £৬.৮ বিলিয়ন অর্থনীতিতে যোগ করবে। আগামী ১০ বছরে মোট জিডিপি বৃদ্ধি ০.৪% হতে পারে, যার আর্থিক মূল্য £১৫.১ বিলিয়ন।
৫. প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি, তবে বিদেশি সহায়তা কমানো
রিভস ঘোষণা করেছেন যে আগামী বছর প্রতিরক্ষা বাজেটে অতিরিক্ত £২.২ বিলিয়ন যোগ করা হবে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় মোট জিডিপির ২.৫% করা।
তবে এই অর্থ সরাসরি আসবে বিদেশি সহায়তা বাজেট কমানোর মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী আগেই ঘোষণা দিয়েছেন যে ২০২৭ সালের মধ্যে বিদেশি সহায়তা ব্যয় জিডিপির ০.৫% থেকে ০.৩%-এ নামিয়ে আনা হবে, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন স্তর।
৬. সরকারি খরচ কমাতে প্রশাসন সংকোচন
সরকারি দপ্তরগুলোর ব্যয় কমানোর জন্য সিভিল সার্ভিস খাতে ১৫% ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে £২ বিলিয়ন সাশ্রয় করবে।
এছাড়া, এনএইচএস (NHS) ব্যবস্থাপনা খাতে কৃচ্ছ্রসাধন করা হবে এবং কর ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে বছরে £৬.৫ বিলিয়ন অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
এই বাজেট ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
• সমালোচকরা বলছেন, এই কাটছাঁটের ফলে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠী আরও সংকটে পড়বে।
• অনেক লেবার এমপি ও মানবাধিকার কর্মী সরকারের এই নীতির সমালোচনা করেছেন, এবং দাবি করেছেন অতি-ধনী ব্যক্তিদের ওপর কর বৃদ্ধি করে বাজেট ভারসাম্যপূর্ণ করা উচিত ছিল।
• তবে সরকার বলছে, এই বাজেট দেশের প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আবাসন খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
শেষ কথা
রাচেল রিভসের বসন্ত বাজেট ঘোষণা একদিকে সরকারি ব্যয় সংকোচন ও সামাজিক সুবিধা কমানোর মাধ্যমে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করছে, অন্যদিকে প্রতিরক্ষা ও আবাসন খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বড় প্রভাব ফেলবে, যা রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে।