চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর প্যান গংশেং সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তারকারী মার্কিন ডলারের একক আধিপত্য শিগগিরই একটি বহুমেরু কাঠামোর মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তার মতে, রেনমিনবি বা চীনা ইউয়ানের ভূমিকা আগামী দিনে আরও ব্যাপক হতে পারে।
তিনি বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন ডলার বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় আধিপত্য কায়েম করেছে। তবে ভবিষ্যতে একটি এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যেখানে একাধিক সার্বভৌম মুদ্রা পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও ভারসাম্য রক্ষা করবে।”
রেনমিনবির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব
চীনের এই আর্থিক নীতিনির্ধারক জানান, ইউরো চালুর পর এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পরে রেনমিনবির গুরুত্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রমশ বেড়েছে। বর্তমানে রেনমিনবি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অর্থায়ন মুদ্রা এবং তৃতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক পেমেন্ট মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তিনি এই মন্তব্য করেন চীনের অর্থনৈতিক রাজধানী সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত একটি প্রধান আর্থিক সম্মেলনে। এর একদিন আগে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দ বলেন, “ডলারের প্রভাব এখন আর নিশ্চিত নয়”, এবং ইউরোর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়ার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন।
ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ ও বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজ
প্যান গংশেং সতর্ক করে বলেন, “ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ, জাতীয় নিরাপত্তা এবং যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কোনো একটি প্রধান মুদ্রা সহজেই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।” এর বিকল্প হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর স্পেশাল ড্রইং রাইটস (SDR)-এর ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান জানান, যা একাধিক মুদ্রার একটি ঝুড়ি হিসেবে কাজ করে।
ডিজিটাল রেনমিনবির আন্তর্জাতিকীকরণ
চীন ইতিমধ্যে সাংহাইয়ে একটি আন্তর্জাতিক ডিজিটাল রেনমিনবি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করেছে। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংক এবং কিরগিজস্তানের এলডিক ব্যাংকসহ ছয়টি বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান চীনের নিজস্ব আন্তঃসীমান্ত অর্থপ্রদান পদ্ধতি (CIPS)-তে যোগ দিচ্ছে, যা সুইফটের একটি বিকল্প ব্যবস্থা।
এছাড়া হংকং এবং সাংহাইয়ের মধ্যে একটি নতুন আর্থিক “অ্যাকশন প্ল্যান” স্বাক্ষর হয়েছে, যাতে রেনমিনবিভিত্তিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রেনমিনবির ক্রমবর্ধমান ভূমিকা
চীনা মুদ্রা রেনমিনবির উত্থান ইতিমধ্যে চোখে পড়ার মতো হয়েছে। পান গোংশেং জানান, বর্তমানে রেনমিনবি হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অর্থায়ন মুদ্রা এবং তৃতীয় বৃহত্তম পেমেন্ট মুদ্রা।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর রেনমিনবির গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে এবং তা এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য একটি শক্তি হয়ে উঠছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও ডলার নির্ভরতার ঝুঁকি
গভর্নর পান সতর্ক করে বলেন, “যখন ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ বা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন আন্তর্জাতিক ডলার ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।”
এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বহুমাত্রিক মুদ্রাব্যবস্থা সেই ঝুঁকি কমাতে পারে।
ডিজিটাল রেনমিনবির প্রসার ও নতুন পদক্ষেপ
চীন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রেনমিনবির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। সাংহাইয়ে সম্প্রতি ডিজিটাল রেনমিনবির জন্য আন্তর্জাতিক অপারেশন সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের OCBC ব্যাংক ও কিরগিজস্তানের এলডিক ব্যাংকসহ ছয়টি বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান চীনের CIPS (Cross-Border Interbank Payment System)-এ যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা SWIFT-এর বিকল্প একটি পেমেন্ট ব্যবস্থা।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রতিক্রিয়া
চীনা গভর্নরের বক্তব্যের আগের দিন ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দে বলেন, “ডলারের প্রাধান্য এখন নিশ্চিত নয়,” এবং ইউরোকে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে নতুন নেতৃত্ব নেওয়ার সুযোগ দেখছেন।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট
বিশ্বমঞ্চে রেনমিনবির প্রভাব বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোরও নতুন সুযোগ এবং কৌশল নির্ধারণের সময় এসেছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রিজার্ভ মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় রেনমিনবির সম্ভাব্য গুরুত্ব নতুন আলোচনার জন্ম দিচ্ছে, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য।
চীনা কর্তৃপক্ষ আরও ঘোষণা দিয়েছে, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদেশে সম্পদ কেনার সুযোগ বাড়াবে — যা দেশের ভিতরে বৈদেশিক বিনিয়োগের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।