নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার সাবেক স্ত্রী সামিরা হক দাবি করেছিলেন এটি আত্মহত্যা, কিন্তু সালমান শাহর পরিবার তা মেনে নেয়নি। পরিবারের অভিযোগ, সালমান শাহকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
দীর্ঘ ২৯ বছর পর সালমান শাহর অপমৃত্যুর মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপ নিয়েছে। গত ২০ অক্টোবর আদালত এ মামলাটিকে হত্যা মামলা হিসেবে রূপান্তরের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশের পরদিনই সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম রমনা থানায় আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে ১৯৯৭ সালে দেওয়া আসামি রেজভীর একটি জবানবন্দি, যেখানে তিনি সালমান শাহ হত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন। রেজভী তার ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে জানান, “আমরাই সালমান শাহকে হত্যা করেছি, ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে সাজানো হয়েছে।” তার দাবি, হত্যাকাণ্ডে সামিরা হক, তার মা লতিফা হক লুসি এবং আরও কয়েকজন জড়িত ছিলেন।
রেজভীর মতে, সালমান শাহর মৃত্যুর পেছনে ছিল ১২ লাখ টাকার চুক্তি, যা করেন সালমান শাহর শাশুড়ি লতিফা হক লুসি। চুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক ডন, ডেভিড, ফারুক ও জাভেদ।
রেজভী জানান, ১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাতে গুলিস্তানের এক বারে তারা বৈঠকে বসেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডন, ডেভিড, ফারুক, জাভেদ, ছাত্তার ও সাজু। ফারুক জানায়, সামিরার মা ২ লাখ টাকা দিয়েছেন এবং মোট ১২ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সালমানকে ‘শেষ করে দেওয়ার’ জন্য। প্রথমে ৬ লাখ টাকা আগাম এবং বাকি ৬ লাখ টাকা কাজ শেষে দেওয়ার শর্তে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। এরপর তারা হত্যার সরঞ্জাম হিসেবে প্লাস্টিক দড়ি, সিরিঞ্জ ও রিভলভার সংগ্রহ করে।
রেজভীর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, ‘এরপর ওই রাতে বার থেকে এফডিসি এসে শুটিং শেষে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় আমাকে সালমান শাহর বাসায় নিয়ে যায় ডন। ওই বাসায় ডন, ডেভিড ও ফারুকের যাতায়াত ছিল বলে দারোয়ান কিছু বলেনি। সালমানের বাসায় লিফটে ওঠার আগেই ডান পাশে রুবী নামে এক মেয়ের রুমের দরজায় ডন নক করলে রুবী নাইটি পরা অবস্থায় দরজা খোলে। এরপর বলে, “ও তোমরা এসেছ।” তখন ডন রুবীকে বলে, ‘আজিজ ভাই কোথায়?’ বাথরুম থেকে আজিজ ভাই বের হয়ে আসে। এরপর আমরা উপরে উঠি। আজিজ ভাই চারতলায় নেমে যায়। আর আমরা ১১ তলায় নেমে সালমানের বাসায় যাই। দরজা আগে থেকেই চাপানো ছিল। দরজা খুলেই দেখা যায় সালমান বেডরুমে শুয়ে আছে। পাশে সামিরা নাই। তখন ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুকরা মিলে সালমানের ওপর ঝাঁ: পিয়ে পড়ে। এ সময় ফারুক তার পকেট থেকে ক্লোলোফর্মের সিসি বের করে সামিরাকে দেয়। সামিরা তা দিয়ে সালমানের নাকের ওপর চেপে ধরে। ডন সালমানের বুকের ওপর গিয়ে বসে। আর ফারুককে বলে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে ডাক। ফারুক তখন বাইরে গিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে আসে। এরই মধ্যে সামিরার মা ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে আসে। তখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। সালমানের খুব শক্তি ছিল। ইনজেকশন দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন সবাই মিলে সালমানকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে ডেভিড সালমানের পা বাঁধে। আজিজ ভাই ডনকে ই: নজেকশন দিতে বলে। পরে সামিরা পুশ করে, তার মা সামিরাকে পুশ করতে সাহায্য করে। পরে সালমান নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ই: নজেকশন পুশ করার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ফ্যানটা সালমান শাহর ঘাড়ের ওপর ছুড়ে মেরেছিল। ড্রেসিং রুমে একটা মই ছিল। আজিজ মোহাম্মদ ভাই আমাকে মইটা আনতে বলে। আমি এনে দিই। এরপর তিনি দড়ি চান। তখন ডন নিজের কোমরের দড়িটা খুলে আজিজ ভাইয়ের হাতে দেয়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দড়িটি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বাঁধে। তাতে আমি, সামিরা, সামিরার মা সাহায্য করি। পরে সালমানের পায়ে বাঁধা রশিটা খুলে বুকের ওপর উঠে গলায় চাপ দিয়ে রাখে এবং পরীক্ষা করে দেখে যে নিঃশ্বাস নেই। উপরের রশিটা খানিকটা ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে দেখানো যায় যে, লাশটাকে ঝোলানো থেকে খোলা হয়েছে। পরে সালমান সু: ইসাইড করেছে এটা দেখানোর জন্য তাকে তেল মালিশ করা হয়, কাপড় ভিজিয়ে শরীরে রাখা হয়। এরপর যে যার মতো চলে যাই। আমিও ফরিদপুর চলে যাই। এরপর কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। কিছুদিন পর ডনের সঙ্গে ঢাকায় দেখা হলে আমাকে জানায় দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। আজিজ মোহাম্মদ ভাই সব ঠান্ডা করে দিয়েছে। পরে আমি আবার বাড়িতে গেলে ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জুলাই ডন ও ডেভিড আমাদের বাড়িতে আসে। ডন আমাকে বলে, কেইসটা আবার নাড়া দিয়ে উঠেছে। যেহেতু আমাদের সঙ্গে ছিলে। এখন আমাদের সাহায্য করতে হবে। আমাকে তারা প্রয়াত চিত্রপরিচালক আলমগীর কবিরের ছেলে লেনিন সেজে সালমানের বাবা-মার বাসায় যেতে বলে। এরপর গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সালমানের ছোট ভাই বিল্টুকে অ: পহরণ করে সালমান হ: ত্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে বলে পরিকল্পনা হয়। তবে ওই বাসায় লেলিন সেজে গেলে আমি ধরা পড়ি। সালমান শাহ আত্মহ: ত্যা করেনি। এটি একটি পরিকল্পিত হ: ত্যাকাণ্ড।’
শুধু আসামি রেজভীই নয়, আসামি রুবীও স্বীকার করেন এটি একটি হ: ত্যাকাণ্ড। আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, রেজভী আহমেদের দোষ স্বীকারোক্তি অবজ্ঞা করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তিনি জবানবন্দিতে ভিকটিম সালমান শাহকে হ: ত্যা করার কথা বলেছেন। কিন্তু ওই স্বীকারোক্তির পরও পুলিশ কর্তৃক সালমান শাহকে হ: ত্যার অভিযোগে এজাহার দায়ের করা হয়নি।
সে সময় সামিরা, তার মা লুসি ও তাদের আত্মীয়া রুবিও উপস্থিত ছিলেন।
সালমান শাহর মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যু হলেও এতদিন পর্যন্ত একাধিক তদন্ত কমিটি ঘটনাটিকে “অপমৃত্যু” হিসেবে উল্লেখ করে এসেছে। তবে পরিবার ও ভক্তদের দাবি, প্রকৃত সত্য গোপন করা হয়েছে। অবশেষে ২৯ বছর পর মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে পুনরায় তদন্ত শুরু করেছে রমনা থানা পুলিশ।
বর্তমানে মামলায় মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। প্রধান আসামি হিসেবে আছেন সালমান শাহর সাবেক স্ত্রী সামিরা হক। অন্য আসামিরা হলেন প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, খলনায়ক ডন, লতিফা হক লুসি, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, মেফিয়ার বিউটি সেন্টারের রুবি, আবদুস সাত্তার, সাজু ও রেজভী আহমেদ ফরহাদ।
মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে রমনা থানা পুলিশ সম্প্রতি সালমান শাহর ইস্কাটন প্লাজার সেই পুরোনো ফ্ল্যাটে পরিদর্শন করেছে, যেখানে তিনি মৃত্যুর আগে স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে বসবাস করতেন। নায়কের মৃত্যুর পর ফ্ল্যাটটি দীর্ঘদিন সিলগালা করে রাখা হয়েছিল, পরে তা নতুন মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে সেই ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
চিত্রনায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলার আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে রমনা থানা পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি আদালতের নির্দেশে পুনরায় তদন্তাধীন রয়েছে। তাই যাতে কোনো আসামি দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য রমনা থানা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মামলার তদন্ত এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। সেই কারণে আসামিদের দেশ ছাড়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তার সাবেক স্ত্রী সামিরা হক ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও সালমান শাহর পরিবার শুরু থেকেই এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করে আসছে।
দীর্ঘ ২৯ বছর পর সালমান শাহর অপমৃত্যুর মামলা এখন হত্যাকাণ্ডে রূপ নিয়েছে। গত ২০ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ আদালত অপমৃত্যু মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের নির্দেশ দেন। আদালতের সেই নির্দেশের পরের দিনই সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলায় মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। প্রধান আসামি অভিনেতার সাবেক স্ত্রী সামিরা হক। অন্য আসামিরা হলেন—প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, খলনায়ক ডন, লতিফা হক লুসি, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, মেফিয়ার বিউটি সেন্টারের রুবি, আবদুস সাত্তার, সাজু ও রিজভী আহমেদ ফরহাদ।