হিমালয় থেকে নেমে আসা তিনটি প্রধান নদী—যমুনা, পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের বাহিত পলিমাটির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ, ভোলা। এই নদীগুলো যখন সাগর মোহনায় মিলিত হয়, তখন পূর্ব দিকে মেঘনা ও পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। ফলে কালক্রমে পলি ও বয়ে আসা বর্জ্য জমে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়।
আনুমানিক ১২৩৫ সালের দিকে এখানে প্রথম চর জাগতে শুরু করে, আর ১৩০০ সালের দিকে মানুষ চাষাবাদ শুরু করে। ১৫০০ সালের দিকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা এ দ্বীপের প্রতি নজর দেয় এবং এটিকে ঘাঁটি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট চালায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভোলার আদি নাম ছিল “শাহবাজপুর”। আজও পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া কিছু বিশাল আকৃতির রোমশ কুকুর ভোলার আরেকটি দ্বীপ মনপুরায় বিচরণ করে, যা একসময় জলদস্যুদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল।
১৮৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলা নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, পরবর্তীতে এটি বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রায় ৯০ মাইল দৈর্ঘ্য ও ২৫ মাইল প্রস্থের এই পলিমাটির ভূখণ্ডে বর্তমানে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও বিক্রমপুর জেলার বহু মানুষ বসবাস করছে। মূলত নোয়াখালীর হাতিয়া, মজু চৌধুরীরহাট, রামগতি ও আলেকজান্ডার এলাকার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা প্রথমে এখানে বসতি গড়ে তোলে। পাশাপাশি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, হিজলা ও মুলাদী এবং পটুয়াখালীর বাউফল, দশমিনা ও গলাচিপার নদীভাঙা মানুষও ভোলায় এসে বসবাস শুরু করে এবং কৃষিকাজকে জীবিকার প্রধান উৎস হিসেবে গ্রহণ করে।
ভোলায় তিন ধরনের ভাষার প্রচলন দেখা যায়—
১️⃣ পুবাল ভাষা:
আচুক্কা (হঠাৎ), হুনি যা (শুনে যা), এমি আ (এখানে এসো), যাইতাম নো (যাবো না), খাইতাম নো (খাবো না), কিল্লাই যাইতাম (কেন যাবো)।
বাকলাই ভাষা:
হদরে-হশাদে (প্রকাশ্যে), হুকনে আয় (সামনে এসো), কতা কইচ না (কথা বলো না), চুপ্পে-চাপ্পে (গোপনে), জুত কইর্যা থাক (চুপ করে থাক), যাইতারুম না (যেতে পারবো না), কোহোইন্দ্যা যাবি (কোন দিক দিয়ে যাবি), আচ্চুকা (হঠাৎ)।
বরিশাইল্যা ভাষা:
এ ব্যাডা দুদু বারতে যাবানা (এই চাচা বাড়ি যাবেন না?), হুইনগ্যা যা (শুনে যা), আইছো কোম্মে গোনে (কোথা থেকে এসেছো), মুই জাইত পারুম না (আমি যেতে পারবো না)।
ভোলার মানুষেরা অতিথিপরায়ণ ও শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের। এখানকার ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ শীতকালে জামাই আপ্যায়ন—যেখানে হাঁসের মাংস, মহিষের দই ও নদীর টাটকা ইলিশ মাছ পরিবেশন করা হয়। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর রূপালী ইলিশ, সুপারী ও নারকেলের বিশাল বাগান এবং উর্বর কৃষিজমি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে।
এছাড়া ভোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। এখানকার গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা জেলাটির উন্নয়নে আশার আলো জ্বালিয়েছে।
সব মিলিয়ে, নদী, প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও সম্পদের সমন্বয়ে ভোলা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও সমৃদ্ধ একটি দ্বীপ জেলা।