মোহাম্মদ ইউনূস বিশাল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, কারণ কিছু পুলিশ তাদের পোস্টে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, গ্যাং অপরাধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠছে|
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউনূস যখন গত আগস্টে বাংলাদেশে ফিরলেন, তখন দেশটি এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। রাজপথে তখনো শুকায়নি রক্তের দাগ, মর্গে স্তূপ করে রাখা হয়েছে হাজারেরও বেশি প্রতিবাদকারী ও শিশুর মরদেহ।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে এক ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লব। আন্দোলনের চাপে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, আর বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাসভবন লুট করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
৮৪ বছর বয়সী ইউনূস রাজনীতি থেকে অনেক দূরে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করতেন এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন। ফলে তিনি বেশিরভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন।
কিন্তু যখন ছাত্র বিপ্লবের নেতারা তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানালেন, তখন তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি হন।
“শেখ হাসিনা যে ক্ষতি করেছেন, তা বিপুল,” ইউনূস বলেন। “এটি যেন একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশ—ভবন নয়, বরং প্রতিষ্ঠান, নীতি, জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পতন ঘটেছে।”
শেখ হাসিনার শাসনের শেষ পরিণতি: সহিংসতা, নিপীড়ন ও দুর্নীতি
শেখ হাসিনার শাসনজুড়ে দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তার শাসনের শেষ কয়েক মাসে পুলিশের গুলিতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন, যা জাতিসংঘের মতে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” হতে পারে। তবে হাসিনা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তার পতনের পর, বাংলাদেশে ইউনূসের প্রত্যাবর্তন নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। ক্ষমতা নেওয়ার পর ছয় মাসে, মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে, গোপন বন্দিশালাগুলো বন্ধ করা হয়েছে, এবং শেখ হাসিনার শাসনে জড়িত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিচার শুরু হয়েছে।
ইউনূস ঘোষণা করেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এরপর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
নিরাপত্তাহীনতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি
কিন্তু ঢাকা শহরের পথে হেঁটে মনে হয়, দেশটি এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনূসের জনপ্রিয়তা থাকলেও, তার শাসন দক্ষতা এবং সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়াচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতা আমির চৌধুরী বলেন, “এই সরকার শুধু একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা ছিল। এখন কেউ প্রতিদিনের কার্যক্রমের জন্য জবাবদিহি করছে না, ফলে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।”
এদিকে, পুলিশের অনেকে পুরোনো অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় কাজে ফিরতে অনাগ্রহী। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে, ঢাকার রাস্তায় গ্যাং অপরাধ বেড়েছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানি বাড়ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ব্যর্থতার প্রতিবাদে সোমবার বিক্ষোভকারীরা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে।
সেনাবাহিনীর সতর্কবার্তা ও ইউনূসের চ্যালেঞ্জ
সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “দেশ অরাজকতার মধ্যে রয়েছে। বিভাজন চলতে থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।”
যদিও ইউনূস দাবি করেছেন, তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো এবং কোনো চাপ নেই, তবে অনেকেই এটিকে তার সরকারের প্রতি কঠোর সমালোচনা হিসেবে দেখছেন।
শেখ হাসিনার শাসনের দুর্নীতির ছায়া
ইউনূস বলেছেন, “শেখ হাসিনার সরকার ছিল ডাকাতদের পরিবার। তার আদেশে মানুষ গুম হয়েছে, নির্বাচনের ফল বদলানো হয়েছে, আর ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।”
শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহল ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ এসব অর্থ ফেরানোর চেষ্টা করছে, তবে আশার আলো ক্ষীণ।
দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন শেখ হাসিনার ভাইজি, ব্রিটিশ লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিকও। অভিযোগ ওঠার পর তিনি ব্রিটেনের ট্রেজারির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন, যদিও তিনি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ইসলামী উগ্রপন্থার উত্থান
ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি ইসলামী উগ্রপন্থা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কঠোর নন। শেখ হাসিনার আমলে নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি ঢাকায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিল বের করলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে তা ছত্রভঙ্গ করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন
বিদেশ থেকেও ইউনূস সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে তার প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অনুরোধের কোনো জবাব এখনো আসেনি।
শেখ হাসিনা ইউনূসকে “গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাস চালানো একজন গডফাদার” বলে আক্রমণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনও ইউনূসের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর, বাংলাদেশকে দেওয়া ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা বাতিল করা হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, “এই অর্থ দিয়ে এক কট্টর বামপন্থী কমিউনিস্টকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে,” যদিও তিনি কোনো প্রমাণ দেননি।
মাস্ককে বাংলাদেশে আনতে চান ইউনূস
মার্কিন প্রশাসনকে পাশে পেতে ইউনূস টেসলার মালিক ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালুর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এপ্রিল মাসে মাস্কের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইউনূস বলেছেন, “ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, তাই আমি বলছি, আমাদের সঙ্গে চুক্তি করুন।” তবে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করুক বা না করুক, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থামবে না।”